ইচ্ছেশক্তির কাছে অভাব তুচ্ছ

নিজস্ব প্রতিবেদ:

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামের বাবা মোশারফ হোসেন ও মা মাহফুজা খাতুনের বড় ছেলে গোলাম রসুল সুইট। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সুইট। পরিবারের অভাবও দমাতে পারেনি তাকে। ঠিকমতো খেতে না পারা সেই গোলাম রসুল সুইট এখন জজ।

১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে ৬৭তম হয়েছেন সুইট। ১৯ জানুয়ারি ঘোষিত গেজেটে তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরই মধ্যে সহকারী জজ হিসেবে পিরোজপুর জেলায় যোগদান করেছেন তিনি।

বাবা মোশারফ হোসেন কিছুদিন আগেও রাজধানীর উত্তরায় একটি বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করছিলেন। তার স্ত্রী মাহফুজা খাতুন এলাকার অনেকের বাড়িতে করেছেন বুয়ার কাজ। বাবা-মায়ের কষ্টে উপার্জিত সেই টাকায় পড়ালেখা করে তাদের বড় সন্তান গোলাম রসুল সুইট এখন সহকারী জজ।

সুইট জানান, কলেজ শেষ করার পর লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এমন সময় সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমিতে একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। সেখান থেকে এক ভাই আমাকে পরামর্শ দেয় ঢাকায় গিয়ে কোচিং করার। কিন্তু পরিবারের সেই অবস্থা ছিল না। মায়ের একটি গরু ছিল। সেই গরুটি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে ২০১০ সালের ১৭ মে ঢাকা যাই। এরপর একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই।

তিনি বলেন, কিছুদিন পর মায়ের গরু বিক্রি করা সেই টাকাও ফুরিয়ে যায়। বাড়িতেও টাকা চাওয়া বা পরিবারে দেয়ার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। কান্নাকাটি করেছিলাম কোচিং পরিচালকের সামনে। এরপর তিনি আমাকে সেখানে বিনামূল্যে কোচিং ও থাকার ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে সঙ্গে থাকা সহপাঠীদের বন্ধু হয়ে যাই আমি। বন্ধুরাও আমার পারিবারিক অবস্থা জানার পর আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতে থাকে। বন্ধুদের সহযোগিতার কথাগুলো ভুলে যাওয়ার নয়। মা ও বাবা মাঝে মধ্যে এক হাজার বা দুই হাজার করে টাকা দিত। গত এক মাস আগে বাবাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। মাকেও এক বছর আগে অন্যের বাড়িতে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি।

২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার গল্প জানিয়ে গোলাম রসুল সুইট বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ হয়। বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হই। ভর্তির পর টিউশুনির পোস্টার ছাপিয়ে অভিভাবকদের কাছে বিতরণ শুরু করি। এভাবে পাঁচ টি টিউশুনি জোগাড় হয়ে যায়। এভাবেই চলেছে আমার শিক্ষাজীবন।

আত্মীয়-স্বজনরা কখনও খোঁজ নেয়নি; তবে আমার বন্ধুরা আমার পাশে থেকেছে সব সময়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ফলাফলে বি-ইউনিটে মেধাতালিকায় হয়েছি ১১তম। ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে হয়েছি ৬৭তম। ১০০ জন উত্তীর্ণ হয়েছিল। এর মধ্যে নিয়োগ হয়েছে ৯৭ জনের। তিনজন পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাদ পড়েছেন।

তিনি আরো বলেন, আমার বড় লোক হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। সব সময় ন্যায়ের পথে থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যাব। কখনও অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হবো না। যখন চাকরিজীবন শেষ করবো তখন যেন অবৈধ উপায়ে উপার্জনের একটি টাকাও আমার ব্যাংক একাউন্টে না থাকে। আমার কাছে সব মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। অসহায় মানুষরা কখনই ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।

দুস্থ পরিবারের সমস্যাগুলো আমি বুঝি, জানিয়ে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গোলাম রসুল সুইট বলেন, টাকা-পয়সা লেখাপড়ার পথে কোনো বাধা নয়। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সে এগিয়ে যাবেই, পথ বেরিয়ে যাবেই।

সুইটের বাবা মোশারফ হোসেন জানান, রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে আট বছর সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেছি। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই থাকতাম। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। এক মাস আগে ছেলে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছে। তাই চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছি। ছেলে বলেছে, আমি এখন চাকরি পেয়েছি আপনার কাজ করতে হবে না। ভাবছি, এলাকায় ছোট একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করবো।

অন্যের বাড়িতে কাজের বুয়া থাকাকালীন সময়ে সেসব কথা মনে করে কেঁদে ওঠেন মা মাহফুজা খাতুন। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। স্বামী আর আমার টাকা দিয়েই চলতো সংসার আর দুই ছেলের খরচ। আমরা যেটুকু পেরেছি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ছেলের লেখাপড়া করানোর জন্য। দোয়া করেছি। আল্লাহ্ আমাদের ডাক শুনেছেন। দোয়া কবুল করেছেন। আমি অনেক খুশি। এখন সব মানুষের কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.