- বান্দরবানে কেএনএফ-জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার ১১ জনের জামিন মঞ্জুর - November 21, 2024
- ফরিদগঞ্জেও বাস্তবায়ন হচ্ছে এই প্রকল্প - November 21, 2024
- ধনবাড়ীতে বিএনপি‘র এক বিশাল জনসভা - November 20, 2024
শাহনূর শাহীন, ঢাকা
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ঢাকায় না আসতে ছোট ভাই জাহিদ হাসান আশিককে সতর্ক করেছিলেন সাংবাদিক হাসান মেহেদী। জাহিদের এখন আক্ষেপ— ‘আমাকে সতর্ক করে ভাই নিজেই পরপারে চলে গেলেন।’
গত ১৮ জুলাই সংবাদ সংগ্রহের জন্য পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার হাসান মেহেদী।
আগের দিন অর্থাৎ ১৭ জুলাই ছোট ভাই আশিককে ফোনে হাসান বলেন, ‘এখন ঢাকায় আসিস না। পরিস্থিতি ভালো না। সাবধানে থাকিস। এখন কোনো কাজ করা লাগবে না।’
১৯ জুলাই ঢাকা টাইমস কার্যালয়ে হাসান মেহেদীর জানাজা শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েন আশিক। বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে সতর্ক করে আমার ভাই নিজেই চলে গেলেন। আমার ভাইকে কোথায় পাবো? আমার পড়াশোনা থেকে শুরু করে পরিবার সামলানোর সব কিছু করেছেন।’
‘এখন আমাদের পরিবারে হাল ধরার মতো আর কেউ নেই। আমি তো ছোট এখনো। এখনই আমাকে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। আমি যদি ভেঙে পড়ি আমার বাবা-মা, ছোট ভাই মরেই যাবে। বাড়ি গিয়ে তাদেরকে আমি কী বলবো? আমাকে কে সান্ত্বনা দেবে?’
হাসান মেহেদীর ছোট ভাই আশিক থাকতেন গাজীপুরে। বয়স মাত্র ২৫ বছর। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। হাসান মেহেদী ছিলেন সবার বড়। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই ঢাকা মেডিকেলে ছুটে আসেন।
পরদিন শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিনটায় রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনে হাসান মেহেদীর কর্মস্থল ঢাকা টাইমস কার্যালয়ের সামনে জানাজা শেষে তিনি নিহত ভাইকে নিয়ে আক্ষেপ করেন।
হাসান মেহেদী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে অনার্স করেছেন। তার দুই শিশু সন্তান রয়েছে। বড় কন্যাটির বয়স সাড়ে তিন বছর। ছোট কন্যাশিশুর বয়স মাত্র সাত মাস।
জাহিদ বলেন, ‘নিশা ও মেহের ছিল আমার ভাইয়ের কলিজার ধন। তাদের নিয়েই ছিল তার স্বপ্নের স্বর্গ। অবুঝ সন্তানগুলো জানেও না ওদের বাবা আর নেই। আমি এখন ওদের কী বলবো? কী বলে সান্ত্বনা দেবো? আমি তো নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই হাসান মেহেদী ওখানে ছিলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফুটেজ নেন। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি গল্পও করেন সেদিন।
দৈনিক বাংলাদেশের আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ইমান হোসেন ইমন ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, বিকাল সাড়ে পাঁচটার পর যখন পুলিশের একটি এপিসি আসে এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংর্ঘষ শুরু হয় তখন পুলিশের সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে ভিডিও করছিলেন হাসান মেহেদী। এক পর্যায়ে আর্মড পুলিশ ক্যারিয়ারের (এপিসি) শটগানের গুলিতে বিদ্ধ হন তিনি।
ইমন বলেন, ‘পুলিশের গুলিতেই হাসান মেহেদী নিহত হয়েছেন। আমি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পাই। গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় ১০ মিনিট রাস্তায় পড়েছিলেন হাসান। এরপর আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
হাসান মেহেদী ঢাকা টাইমসের হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিটে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতেন। এর আগে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টি ফোর, দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক বাংলাদেশের আলোয় কাজ করেছেন।
গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর সংগ্রহের সময় হাসান মেহেদী রাজধানীর কাজলায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার ওপরের অংশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
গত শুক্রবার বিকালে হাসান মেহেদীর কর্মস্থল ঢাকা টাইমস কার্যালয়ের সামনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে পটুয়াখালীর বাউফলের হোসনাবাদ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় তার মরদেহ। শনিবার সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকলেও সাংবাদিক হাসান মেহেদী মা-বাবার ভরণপোষণ ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার দায়িত্বও সামলে আসছিলেন। তার আয়ের টাকায় পরিবারটির যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হতো।
হাসান মেহেদীর বড় মেয়ে নিশার বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। আর ছোট মেয়ে মেহেরের বয়স মাত্র সাত মাস। এই অবুঝ শিশু দুটি এখনো জানেই না তাদের পরম আদরের বাবা আর বেঁচে নেই। হাসানের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি গৃহিণী। পরিবারের কর্তাটির নির্মম মৃত্যু দুই সন্তানসহ এই মায়ের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে।
বড় ছেলেটি এমন মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ মেহেদী হাসানের সত্তরোর্ধ অসুস্থ বাবা মো. মোশাররফ হোসেন হাওলাদার। আদরের বড় ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু বাক হারিয়েছেন বৃদ্ধা মা মাহমুদা বেগমও।
বাবা মোশাররফ হোসেনের এক এক করে পাঁচবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। রয়েছে ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। মাসে অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার ওষুধ নিতে হয় তাকে। এই ওষুধের ব্যয় সামলাতেন হাসান মেহেদী।
অন্যদিকে মা মাহমুদা বেগমও বয়সজনিত রোগে ভুগছেন দীর্ঘদিন। এমন অবস্থায় পরিবারটি পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। দাফনের কালে ছেলে হারানো মাহমুদা বেগমের প্রশ্ন ছিল— সাংবাদিকতা কি অপরাধ? যে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.