ঢাকা ছাড়ছে কোটি মানুষ, ৬০ শতাংশই সড়কপথে

আসছে রবিবার পবিত্র ঈদুল আজহা। দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদের আনন্দ। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে কর্মব্যস্ত নগরীর মানুষের ঈদের আগের অফিস। এরপরই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটতে শুরু করে রাজধানীবাসী। রেল স্টেশন, বাস কাউন্টারে ঘরমুখী মানুষের ঢল। ধারণা করা হচ্ছে এবার এক কোটির বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। এদের বেশিরভাগই যাচ্ছেন সড়কপথে। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে এবার সড়কপথে যাত্রীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে।

 

 

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, এবার প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। এদের ৬০ শতাংশই সড়ক পথে ঢাকা ত্যাগ করবে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী যত মানুষ ঢাকা ছাড়বেন তার ৫৪ শতাংশ আজকে (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ঢাকা ছেড়ে গেছেন।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবার মোট যে পরিমাণ মুভমেন্ট হবে তার ৬০ শতাংশ হবে সড়ক পথে। রেলে হবে ১২ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া নৌ-পথে যাবে ৩৫ শতাংশ এবং বাকি ৩ শতাংশ যাবে আকাশপথে।

ট্রান্সপোর্টের হিসাব অনুযায়ী এই হিসেবটা বের করা হয় জানিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, এবারে ঈদযাত্রায় মানুষের দুর্ভোগ খুব একটা হবে না। মানুষ আগে থেকেই ভাগেভাগে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে।

নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবার মাত্র ১০ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রা করবেন বলে ধারণা করছেন মোজাম্মেল হক। বলেন, প্রতি বছর ঈদে মোটরসাইকেলে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। তবে এবার মোটরসাইকেলে বিধিনিষেধ থাকার কারণে আগের চেয়ে অর্ধেক মানুষ মোটরসাইকেলে ঢাকা ত্যাগ করবেন।

 

 

আসনবিহীন টিকিটের সন্ধান, রেলযাত্রায় ঘরমুখী মানুষের ঢল

বৃহস্পতিবার ঈদের আগের শেষ অফিস হওয়ায় কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘরমুখী মানুষের ঢল নামার চিত্র ছিল চোখে পরার মতন। সরেজমিনে দেখা যায়, ঈদযাত্রায় রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট প্রত্যাশী মানুষের সারি। কাউন্টারগুলোতে আসনবিহীন টিকিট দেওয়া হচ্ছে।

বৃহস্পতিবারও প্রায় প্রতিটা কাউন্টারের সামনেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন টিকিট প্রত্যাশীরা। কাউন্টার মাস্টার একে একে টিকিট দিচ্ছেন। অনুসন্ধান কক্ষ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার ১১ জুলাইয়ের টিকিট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাউন্টারে যোগাযোগ করে এবং টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত আসনবিহীন টিকিটই বিক্রি হচ্ছে।

 

 

বৃহস্পতিবার বেলা ১০টার পর থেকে রেলস্টেশনে বাড়তে থাকে মানুষের চাপ। গেটে টিকিট চেক করে স্টেশনের ভেতরে যাত্রীদের ঢুকতে দিচ্ছেন নিরাপত্তাপ্রহরীরা। আবার অনেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই স্টেশনে এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ আবার আসতে একটু দেরি হওয়ায় ব্যস্ততার মধ্যে দৌড়-ঝাপ করছেন। কেউবা আবার এখনও খোঁজ করছেন বহুল প্রত্যাশিত টিকিটের। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আসনবিহীন টিকিট কাটছেন।

এক যাত্রীর টিকিটে দেখা গেছে, চট্টলা এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছেন ঢাকা থেকে ভৈরবগামী একজন যাত্রী। দুপুর ১২টা ৩২ মিনিটে কাটা টিকিটটিতে যাত্রার সময় দেওয়া হয়েছে দুপুর ১টা। ভাড়া নেওয়া হয়েছে ৮৫ টাকা। তবে আসনের জায়গায় লেখা আছে ‘আসনবিহীন’।

আসনবিহীন টিকিট কাটা অন্য এক যাত্রী আরমান শেখ বলেন, গত বেশ কয়েকদিন ঘুরেও টিকিট ব্যবস্থা করতে পারিনি। ঈদে তো আর একা ঢাকায় থাকা যাবে না। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে হবে। তাই কষ্ট হলেও ট্রেনে দাঁড়িয়ে যেতে পারলেই খুশি।

 

বাবা-মা ও চাচা-চাচির সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছেন ছোট্ট শিশু হুসাইন হুরাইরা। সঙ্গে আছে তারই ছোট আরও দুইটি ভাই। বাড়িতে যাবে ভাবতেই খুশি, খুশি ভাব চোখে ভেসে উঠেছে।

হুসাইন ঢাকাটাইমসকে বলেন, অনেকদিন পরে বাড়িতে যাচ্ছি। গত ঈদের সময়ও বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঈদে বাড়ি না গেলে কিছু ভালো লাগে না। বাড়িতে দাদা-দাদিসহ আরও সবাই রয়েছে। তাদের রেখে ঢাকাতে ঈদ করলে একটুও ভালো লাগে না।

 

ট্রেন মিস হবার ভয়ে অনেকেই আগে ভাগে এসেই ভিড় জমিয়েছেন স্টেশনে। দুই ঘণ্টা আগেই কাউন্টারে এসে বসে আছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা সাঈদ আহমেদ। তিনি বলেন, আজকে তো ছুটি শুরু, মানুষের ভিড় বেশি হবে। এটা আগেই অনুমান করেছিলাম। তাই আগে থেকেই চলে এসেছি।

সায়েদাবাদে বাসের টিকিট সংকট, ঘরমুখো যাত্রীদের দুর্ভোগ

‘মহাবিপদে আছি। দুই দিন ধরে সায়েদাবাদের বিভিন্ন বাসের কাউন্টার ঘুরে টিকিট পেলাম না। খুবই দুঃখ লাগছে। প্রতিদিন আসছি চট্রগ্রামের টিকিটের জন্য। কাউন্টার ম্যানেজার বা কর্মীরা আশা দিয়ে যাচ্ছে আজ-কাল বলে। সায়েদাবাদ বাসের টিকিট কাউন্টারে সিন্ডিকেটের জন্য আমার মতো শত শত মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।‘

বৃহস্পতিবার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বাসযাত্রী রবিউল আলম।

 

রবিউল আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি আমার পরিবার নিয়ে চট্রগ্রামে যাবো ঈদ করতে। আমার দেশের বাড়িতে গরু কুরবানি দেওয়া হবে। ঈদুল ফিতরে যাইনি এই ঈদে যাওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত দেখলাম হানিফ বাসের কাউন্টারে ১১শ’ টাকার টিকিট দুই হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এসব দেখে তো অবাক হয়ে গেছি। কাউন্টারে টিকিট থাকার পরেও টিকিট দিচ্ছে না বেশি দামে বিক্রি করার জন্য।‘

দুয়ারে কড়া নাড়ছে কোরবানির ঈদ। তাই নাড়ির টানে ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামে যাচ্ছেন কর্মব্যস্ত মানুষ। এতে করে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ বেড়েছে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন জেলা শহরে। তবে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেছেন ঘরমুখো যাত্রীরা।

 

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঘুরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে অতিরিক্ত ভিড় দেখা গেছে।

বাসযাত্রীদের কাছ থেকে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঈদের ছুটি দেওয়াতে ভিড় বেড়েছে। এবার ঈদের আগে শুক্র-শনিবার হওয়ায় শেষ মুহূর্তের ভোগান্তি এড়াতে বৃহস্পতিবারেই বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছেন অনেকে। যারা এখনো টিকিট নিতে পারেননি তারা বাড়ি গিয়ে ঈদ উদযাপন করা অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন।

বশির মিয়া নামে একজন ঢাকাটাইমসকে জানান, সায়দাবাদ টিকিট কাউন্টারে টিকিট থাকার পরেও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। সিলেটের ৬৫০ টাকার টিকিট এক হাজার টাকার বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাসযাত্রীরা।

বাসযাত্রী একলাসুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাসে সিট খালি আছে। তারপরও সিট দিতে রাজি না কাউন্টারের স্টাফ বা ম্যানেজাররা। শ্যামলীতে গিয়ে বলছি ৮ জুলাইয়ের টিকিট লাগবে। সিট খালি থাকার পরেও টিকিট দেয়নি। কারণ একটাই, বেশি টাকায় টিকিট বিক্রি করবে। এরকম সিন্ডিকেট হলে তো দেশের মানুষ মহাবিপদে পড়বে।’

বাসযাত্রী দুদুমিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাস হিমাচলের ম্যানেজারের আচরণ খুব খারাপ। বাসের টিকিট আকাশ ছোঁয়া দাম। এর মধ্যে মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। এসব কেউ দেখে না। বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরে আসা উচিত।‘

 

হিমাচল ও হানিফের কাউন্টার ম্যানেজার আল-আমিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের যে কয়টা বাস রয়েছে এর মধ্যে বরিশালের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। আর সব জেলা বিভাগের বাসের টিকিট শেষ। আমাদের কিছু করার নেই। টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আমরা নাকি টিকিট রেখে টিকিট বেশি দামে বিক্রি করার জন্য বেসে আছি। এখন শুধু আগে টিকিট সংগ্রহ করা যাত্রীরা যেতে পারবেন। নতুন টিকিট নিতে পারবে না।’

শ্যামলী বাসের ৯ নম্বর কাউন্টারের ম্যানেজার মো. আরিফ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার, টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের শ্যামলী বাস যাতায়াত করে। এখন শ্যামলী বাসে কোনো ধরনের টিকিট নেই এবং মানুষের ভিড়ও জমেছে। যাদের টিকিট সংগ্রহ করা আছে একমাত্র তারাই যেতে পারবেন।’

নৌ-পথে নেই সেই চিরচেনা রূপ

বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার ঈদযাত্রায় ঘরমুখী মানুষের নৌ-পথের চিত্রটা ছিল অনেকটায় ভিন্ন। প্রতি বছরের মত এবার যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় ছিল না। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের কারনেই মূলত কোনোরকম ভোগান্তি ছাড়াই মানুষ এবার নৌ-পথে ছুটছেন বাড়ি।

বৃহস্পতিবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর সদরঘাটে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঘরমুখো যাত্রীর চাপ সকাল থেকে না থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই বাড়তে শুরু করে মানুষ। তবে প্রতিবছরের ন্যায় ভিড়ের চিত্রটা অতি সামান্য। টিকিট পেতেও ছিলনা কোন বাড়তি ঝামেলা।

এদিকে, ভিড় এড়িয়ে যাত্রীরা গন্তব্যে যাত্রা করতে পেরে বেশ খুশি। বরিশালগামী যাত্রী মাহবুবুর রহমান বলেন, ভেবেছিলাম প্রতি বছরের মতন এবারও ভিড় হবে। এখানে এসে দেখছি তার উল্টো চিত্র। কোন ধরনের ঝামেলা নেই দেখেও ভালো লাগছে।

এদিকে এবার ঈদে যাত্রী পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন, প্রত্যেক বাহিনীর আলাদা কন্ট্রোল রুম স্থাপন, যাত্রীদের নিরাপদে লঞ্চে আরোহনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ সার্বক্ষণিক মাইকিং করে নির্দিষ্ট লঞ্চের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নদীবন্দরে পর্যাপ্ত বিশ্রামাঘার, পাবলিক টয়লেট ও পার্কিং সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.