চলমান সংকট মোকাবিলায় সরকারের নানামুখী উদ্যোগ

চলমান সংকট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে সরকারি অফিসের সময়সীমা কমিয়ে বা এগিয়ে আনা, সরকারি-বেসরকারি অফিসে এসির ব্যবহার ২৫ ডিগ্রির নিচে না নামানো, মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসির ব্যবহার কমানো, বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে শেষ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুপারিশ করা হবে।

 

বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারাদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন।

বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশ ভয়ানক লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে। একইসঙ্গে গ্যাসের সংকটও দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

 

তিনি বলেন, ‘দোকানপাট, বিপনীবিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করার যে সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়েছে, ঈদের পর সেটা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে।’

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা পিক আওয়ারে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে কিন্তু এসব উদ্যোগের মাধ্যমে এই চাহিদা ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা সম্ভব। তাহলে লোডশেডিং খুব বেশি করতে হবে না।’

 

 

তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘আমাদের এখন ৫০০ মেগাওয়াটের ঘাটতি রয়েছে, চাহিদা কমিয়ে এই ঘাটতি মোকাবিলা করা হবে। অনেক উন্নত দেশেও এখন সমস্যা হচ্ছে, সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।’

কোন এলাকায় কখন লোডশেডিং হবে, সেটি জানার জন্য ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছে, অন্য কোম্পানিগুলোও সেটা ব্যবহার করবে জানিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের মনিটরিং টিমগুলো শক্তিশালী করে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’

 

গত বুধবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) পাওয়ার, এনার্জি অ্যান্ড ইউটিলিটিজবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের প্রভাবে শিল্পকারখানার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন শিল্পোৎপাদনের জন্য কারখানায় বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করা জরুরি। সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুতের রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরবরাহ–সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম চড়া, তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার।

 

সিলেটের ছাতককেন্দ্রিক বহুজাতিক একটি সিমেন্ট কোম্পানিকে সম্প্রতি চিঠি দিয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে গ্যাস সরবরাহকারী একটি সংস্থা। এমন চিঠি পাওয়ার পর কোম্পানিটি বিকল্প উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে ওই কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল গত ৯ জুন বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

 

বর্তমানে দেশে যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট চলছে তা অর্থমন্ত্রীর সেই আশঙ্কারই বাস্তব চিত্র বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থমন্ত্রী তা একমাস আগে চিন্তা করেছেন আর একমাস পড়ে এসে সেই বাস্তব চিত্রের মুখোমুখি হয়েছে দেশের মানুষ।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বর্তমান এ সংকট কতটা সামাল দিতে পারে সরকার তা বলার কোনো বিকল্প নেই। এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে আপাতত যতটুকু সংকট সামাল দেওয়া যায় তা-ই করুক। একই সময়ে যদি গ্যাসের উৎপাদনটা বাড়াতে পারে তা হবে উপযুক্ত।’

বাংলাদেশ ৮০ শতাংশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি নির্ভর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে মূল কাঁচামাল সেটা আমরা আমদানি করে থাকি। যেহেতু বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়েছে, সেহেতু আগে যে পরিমাণে কেনা হতো সেভাবে এখন কেনা হচ্ছে না। সে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কম হচ্ছে।’

 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৮৮ লাখ মানুষকে দেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর জন্য। পাকিস্তান, লাউসেও একই অবস্থা। আর নেপালের অবস্থা তো আরো খারাপ। স্পটতই এটা একটা বিশ্ব সংকট। তাই এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে যতটুকু সচেতন হওয়া যায় ততটুকুই হতে হবে। আমি বলবো বাংলাদেশ সরকার এ জায়গায় অনেক সচেতন। আগে থেকেই তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর বলা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হবে— এমন পরিস্থিতেই আমরা বর্তমানে অবস্থান করছি কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অবশ্যই অর্থমন্ত্রীর সেই বক্তব্য অনুযায়ী আমরা বর্তমান সময়ে অবস্থান করছি। এরমধ্যে আমদানি কমানোর জন্য এলসি মার্জিন ৭৫ শতাংশ থেকে শতভাগ আরোপ করেছে এটাও সেই বাজেটেরই একটা প্রতিফলন।’

 

 

তিনি বলেন, ‘চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট বর্হিবিশ্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে। জ্বালানির ওপরে আমাদের একটা বড় অংশই হচ্ছে আমদানি নির্ভর। সুতরাং এসবের যেহেতু দাম বেড়ে গেছে সেহেতু এসব ব্যবহার কমানো ও সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

 

 

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট নিরসনে চাহিদা ব্যবস্থাপনার ওপরও বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে দাম সমন্বয় করা হতে পারে। যা আমি মনে করি অনেকটা বাধ্য হয়েই করতে হচ্ছে বা করতে হবে। এছাড়া আমি আপাতত আর বিকল্প কোনো উপায় দেখছি না।’

 

 

সংকট নিরসনে যেসব সিদ্ধান্ত আসছে এসব সময়োপযোগী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার বর্তমানে এসব সংকট নিয়ে অনেক চাপে আছে। গ্যাস, জ্বালানিসহ অন্যান্য সংকট নিরসনে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এগুলো সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে এসব সিদ্ধান্ত কতোটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা সরকারের অবশ্যই কঠোরভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তবে এটা কতটা বাস্তবায়িত হবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না।’

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.