টাংগাইেলর মধুপুরে প্রাচীন গারো ধর্মকে আকড়ে থাকা এক জনিক নকরেকের গল্প

শুভ চৌহান মধুপুর  টাংগাইল থেকে

শুভ চৌহান মধুপুর উপজেলা প্রতিনিধি টাংগাইল, অনিতাকে প্রাণভরে ভালোবাসতাম। পাহাড়ী টিলার ধানী জমিতে মায়ের সাথে অনিতা কাজে গেলে, নানা ছুঁতোয় জমির অাইলে দাড়িয়ে থাকতাম। অগোচরে অাগাছা পরিস্কারে হাত লাগাতাম দুজনের সাথে। ডানেবায়ে তাকিয়ে মিষ্টি হাসতো অনিতা। অার মা নর্জ মৃ বাঁকা চোখে তাকাতেন। মায়ের কড়া নজর সত্বেও দিনের পর মাস। মাসের পর বছর না পেরোতেই অনিতার সাথে মন দেয়ানেয়া, হৃদয় হরণের পালা শেষ হয়। গারো মাহারী বা সমাজের মানুষ জানতে পারলো, জানতে পেরে বুঝতে পারলো, বুঝতে পেরে অনিতার পরিবারকে চাপ দিলো।
শেষ পর্যন্ত, এক হাড় কাঁপানো পৌষের নিশিতে গারো সমাজের প্রচলিত রীতিনুযায়ী অামাদের দুজনকে ঘরের দুই দরজা দিয়ে এক ঘরে তুলে দিয়ে খিড়কি দিলো। জীবনের সেই রাতে বাইরে পৌষের প্রচন্ড শীত থাকলেও ভেতরে অনিতা অার অামার বসন্ত চলছিল। সে এক অনন্ত ভালোবাসার রাত। সেই ভালোবাসা মন থেকে মনে, দেহ থেকে দেহে, শিরা থেকে উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েছিল। পরম সুখে নিশিবসান ঘটে মোরগ ডাকা ভোরে। দু,হাত মিলিয়ে ছন্দ তোলা পায়ে একই দরজায় হাসিমুখে বেরুলাম। বিহানে দুজনের এক দরজায় হাসিখুশিতে বেরুতে দেখে উৎফুল্ল হলো বাড়ির সবাই।’ তারপর? “তারপর পুরোহিতকে ডাকা হলো।
গারো সমাজের রীতিনুযায়ী মন্ত্রজপ অার মালা বদল হলো। গলা টেনে ছিড়ে ডাবল মোরগ জবাই হলো। শুরু হলো নতুন জীবনের জয়যাত্রা । সেই যে বিনে সূতোর মালায় অনিতা অঙ্কশায়িনী হলো; তা টিকেছিল টানা পয়ষট্রি বছর। এভাবেই নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন, ত্রিকালদর্শী জনিক নকরেক। জনিকের বর্তমান ঠিকানা টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলের চুনিয়া গ্রামে। ইটে গাঁথা, লাল টিনের চৌচালার সুদৃশ্য “চুনিয়া বাংলো” ডাইনে রেখে পায়ে চলা পথ গজারী বন বিদীর্ন করে, প্রবেশ করেছে অাদিবাসী গ্রাম চুনিয়ায়। বাঁক খেয়ে পথের মাথা যেখানে শেষ, সেখান থেকে দশ কদম পা মেললেই পরিচ্ছন্ন মাটির ঘর।
অার সেটিই জনিকের শান্তি নিকুঞ্জ। জনিকের জন্ম ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর পাহাড়ে। বাবার নাম অতীন্দ্র মৃ। মা অনছি নকরেক। মধুপুরের গারো গ্রাম পীরগাছা ছিল নানানানীর বাড়ি। নানার নাম ছিল সুরমান চিরান। অার নানী বালমী নকরেক। সেই সুত্রেই ত্রিপুরা থেকে মধুপুরে অাসা। কৈশোরে দূরন্ত যৌবন যখন উড়ুউড়ু, বনবনানী, পাখপাখালী, বাইদ অার পাহাড়ী ঝর্ণায় মিতালী পাতানোর খায়েশ, ঠিক তখনই মামা বাড়ি বেড়াতে এসে ওয়ানগালা বা নবান্ন উৎসবে নাচগান অার চুং পানের অাসরে চারচক্ষুর মিলন ঘটে। বিয়ের পর অার ত্রিপুরায় ফেরা হয়নি জনিকের। অনিতার গলায় মালা বদলে সেই যে মায়ার বন্ধনে সুর মিলিয়েছিলেন, তা নিয়েই কাটছে পড়ন্ত বেলা। ঘরে ছয় ছেলে, তিন মেয়ে। চার ছেলে ঘর জামাই গেছে।
মেয়ে বৈজয়ন্তী নকনার মর্যাদায় বাড়িতে জামাই এনেছেন। সব মিলিয়ে তার নাতিনাতনীর সংখ্যা ৩০জন। জমিজমা খুব একটা নেই। কায়ক্লেশে দিন চলে জনির। জনিক নকরেক ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চলমান গল্প বাল্যে শুনেছেন। যৌবনে ব্রিটিশ শাসন দেখেছেন। ভারত-পাকিস্তান অান্দোলন ও দেশভাগ দেখেছেন। ” হাত মে বিড়ি মুখমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” শ্লোগান শুনেছেন। তার ও অাগে মধুপুর থেকে ময়মনসিংহ চল্লিশ কিলো পায়ে হেটে গিয়ে মোহাম্মদ অালী জিন্নাহ এবং মহাত্মা গান্ধীর জনসভায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু বৃিটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তানেরর জন্ম হলেও অাদিবাসী গারোদের কোনো লাভ হয়নি। দুই দুই বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গারোরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যান। পরবর্তীতে পাকিস্তান খেদাও অান্দোলন শুরু হলে গারো জনগোষ্ঠি তাতে সক্রিয় অংশ নেয়। বহু গারো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু কেউ রাজাকার বা অালবদরে যোগ দেননি। জনিক জানান, তার জীবনে সবচেয়ে বড় স্মৃতি হলো ১৯৭১ সালের জানুয়ারীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মধুপুর বনাঞ্চলের দোখোলা বাঙলোতে অবস্থানকালে তার সাথে বিরল সাক্ষাৎ ঘটে। বেগম মুজিব সেদিন বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন। দোখলা বাঙলোতে বঙ্গবন্ধু অবস্থানকালে গারো গ্রাম চুনিয়া ভ্রমণ করেন। তিনি অাদিবাসী গারো নেতা প্রয়াত পরেশ চন্দ্র মৃর বাড়িতে গমন করেন। বাঙলোতে ফেরার পথে জনিকের জীর্ণ কুটিরেও বঙ্গবন্ধু একদন্ড বসেছিলেন। এটি তার অমূল্য স্মৃতি। জনিক স্মৃতি হাতড়ে জানান, সে সময় মধুপুর জঙ্গলে জুম চাষ হতো। জুম জমিতে নানা ফসল ছাড়াও স্থানীয় জাতের অানারস অাবাদ হতো। শুধু লবন, কেরোসিন অার বস্ত্র ক্রয় ছাড়া গারোরা জঙ্গলের বাইরে মানে হাটবাজারে যেতেন না। জীবনের সব উপকরণ জঙ্গলেই মিলতো।
তিনি গল্প জমিয়ে বলেন” নিজ হাতে বাঘ, হরিন ও বনমহিষ শিকার করেছি।” বেসরকারি সংস্থা ” শেড” প্রকাশিত গ্রন্থ ” madhupur, the vanishing forest and her people in.agony” থেকে জানা যায়, মধুপুর বনাঞ্চলে অাদিবাসী গারো জনসংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। এদের মধ্যে সাংসারেক বা অাদি গারো ধর্মাবলম্বির সংখ্যা মাত্র ৪৭ জন। দিনে দিনে নানা কারণে মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরা খৃস্ট ধর্ম গ্রহন করে অাধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনায় এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জনিক নকরেকের মতো হাতেগোনা কিছু মানুষ এখনো অাদিধর্ম অাকড়ে পড়ে অাছেন।
জনিক এখনো অাদি গারোদের মতো পূজাপার্বণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। নিজ ধর্মের অাচারনিষ্ঠার প্রতি তার প্রচন্ড অনুরাগ। পরিবারের সবাই খৃস্টান হলেও নিজের মতাদর্শ থেকে তিনি এক চুল ও নড়েননি। ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য কোনো মন্দির নেই। থাকার ঘরের এক অংশকে তিনি মন্দির হিসাবে ব্যবহার করেন। তার অন্তিম ইচ্ছা কেউ না কেউ, কোনো না কোনো দিন তার ডাকে সাড়া দেবেন। তার ধর্মীয় দেবতার পুজা অর্চণার জন্য একটা মন্দির নির্মাণ করে দেবেন। জয়তু জনিক। তোমার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হোক প্রিয় বন্ধু

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.