‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই- ছেটো সে তরী,/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই- ছেটো সে তরী,/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর তার ‘সোনার তরী’তে আর কাউকে জায়গা দিতে না পারলেও আমাদের রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতা ঠিকই জায়গা বের করেছেন তাদের তরীতে (পড়ুন ভল্ট)। নগদ কোটি টাকায় উপচে পড়ে ভল্ট।  এরপর টাকায় কিনতে লাগলেন সোনা, আর রাখতে থাকেন ভল্টে। কোটি টাকা নগদের সঙ্গে তাতে চার কোটি টাকার সোনা অনায়াসেই জায়গা পেয়ে যায়।

আজ র‌্যাবের অভিযানে গেন্ডারিয়া আওয়ামী লীগের দুই নেতা সহোদর এনামুল হক ও রূপণ ভূঁইয়ার পাঁচটি ভল্টে মিলেছে পাঁচ কোটি ৫ লাখ টাকা আর ৭৩০ ভরি স্বর্ণালংকার। ৫৬ হাজার টাকা ভরি ধরে এসব স্বর্ণের দাম ৪ কোটি ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো।

ভল্টে রাখার জায়গা হতো না বলে টাকা দিয়ে সোনা কিনতেন ওই দুই নেতা। ক্যাসিনো থেকে অবৈধ উপায়ে পাওয়া টাকায় এখন তারা ঢাকায় ১৫টি বাড়ির মালিক। অভিযানে জব্দ করা হয় ছয়টি অস্ত্র।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

ক্ষমতাসীন দলের এই দুই নেতা প্রায়ই অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ভয় দেখাতেন বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এবং তার ভাই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রূপণ ভূঁইয়া দুজনই বর্তমানে পলাতক। রূপণ আরামবাগ ক্লাবে জুয়া পরিচালনা করতেন।

আর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অন্যতম অংশীদার এনামুল। সেখানে চলা ক্যাসিনো ও জুয়া থেকে স্রোতের মতো নগদ টাকা আসত দুই ভাইয়ের কাছে। সেগুলো তারা রাখতেন ভল্টে। কিন্তু ভল্টে আর কত জায়গা! টাকায় ভরে যায়। আবার টাকা আসাও বন্ধ নেই। র‌্যাব জানায়, বিপুল পরিমাণ টাকা রাখার জায়গা হতো না বলে টাকা দিয়ে স্বর্ণালংকার কিনতেন এনামুল।

র‌্যাব আজ প্রথম অভিযান চালায় এনামুলের সূত্রাপুরের বানিয়ানগরের মুরগিটোলা গলির বাড়িতে। এই বাড়ির দ্বিতীয় ও পঞ্চম তলায় তিনটি ভল্ট থেকে উদ্ধার করা হয় ১ কোটি ৫ লাখ টাকা ও ৭২০ ভরি স্বর্ণালংকার। জব্দ করা হয় পাঁচটি অস্ত্র।

সূত্রাপুরের বাসায় অভিযান শেষে র‌্যাব নারিন্দায় এনামুলের কর্মচারী আবুল কালাম ওরফে কালার বাসায় হানা দেয়। সেখানে একটি ভল্ট রয়েছে বলে আগেই তথ্য ছিল বাহিনীটির কাছে। ওই ভল্টে পাওয়া যায় দুই কোটি টাকা এবং একটি অত্যাধুনিক বিদেশি পিস্তল। আবুল কালাম আজাদকে ধরতে পারেনি র‌্যাব।

এরপর পাঁচ নম্বর ভল্টের সন্ধান পায় র‌্যাব। এনামুলের শ্যালিকা-শাশুড়ির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় সেটি এবং তাতে মেলে আরও দুই কোটি টাকা। এই বাড়িতে থাকেন শ্যালিকার স্বামী হারুনুর রশিদ। ট্রাকস্ট্যান্ডের কর্মচারী হারুন অভিযানের আগে পালিয়ে যান।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এনামুলের পাঁচটি ভল্টের তথ্য ছিল। সব কটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রথম তিনটি ভল্টে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা ও ৭৩০ ভরি স্বর্ণ; পরের দুটিতে ২ কোটি করে ৪ কোটি টাকা পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে নগদ প্রায় ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, ছয়টি অস্ত্র ও ৭৩০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয় এই অভিযানে।’

র‌্যাবের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল এনামুল অবৈধ ক্যাসিনোর টাকা ও স্বর্ণ পাঁচটি ভাড়া করা ভল্টে রেখেছেন। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘তিনটি ভল্ট মুরগিটোলায় এনামুলের বাড়ি থেকে উদ্ধার করি। সেই অভিযান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নারিন্দায় এনামুলের কর্মচারী আর শ্যালিকা-শাশুড়ির বাসা থেকে একটি করে ভল্ট উদ্ধার করা হয়।’

র‌্যাব-৩ অধিনায়ক জানান, সপ্তাহ খানেক আগে এনামুল হক থাইল্যান্ডে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে। রূপণ দেশেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তার সন্ধানে নেমেছেন র‌্যাবের সদস্যরা।

পুলিশের এই অভিজাত বাহিনীর চলমান অভিযান শুরু হয় সপ্তাহ খানেক আগে গত বুধবার। তারপরই এনামুল দেশ ছাড়েন বলে ধারণা র‌্যাবের।

জুয়া ও ক্যাসিনোবিরোধী প্রথম অভিযানে গত বুধবার ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব থেকে ২০ লাখ টাকা, বিদেশি মদ-বিয়ার, ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম জব্দ এবং ১৮২ জন জুয়াড়িকে আটক করা হয়। একই দিনে বনানীর একটি ক্লাব ও গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে আটক করা ৪০ জনকে। এর এক দিন পর ধানমন্ডি, কলাবাগান ক্লাবে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও জুয়ার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। গতকাল সোমবার আবার অভিযান চালানো হয় মতিঝিলের আরামবাগ, মোহামেডান, দিলকুশা ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে।

র‌্যাব জানায়, ক্যাসিনো ও অবৈধ জুয়ার বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে সূত্রাপুরের বানিয়ানগরে এনামুল ও রূপণদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। তাদের ঢাকায় আরও অন্তত ১৫টি বাড়ি রয়েছে। সূত্রাপুরের বাসায় অভিযান শেষে তাদের নারিন্দার বাসায় হানা দেয় র‌্যাব।

এনামুল ও রূপণরা ছয় ভাই বলে জানায় স্থানীয় লোকজন। ১৯৮৫ সাল থেকে এনামুল ওয়ান্ডারার্স ও রূপণ আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলতেন। হঠাৎ তিন-চার বছর ধরে তারা রাজধানীতে বাড়ি কেনা শুরু করেন। র‌্যাব যে বাড়িটি ঘিরে রেখে অভিযান চালায় সেটি দেড় বছর আগে হারুনুর রশীদ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে কেনেন তারা।

সোমবার মধ্যরাতে র‌্যাব-৩ ঘিরে ফেলে এনামুলের সূত্রাপুরের বাড়িটি। আজ সকাল ১০টার দিকে বাসায় অভিযান চালায়। দুপুরে এখানে অভিযান শেষে নারিন্দার বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব।

এনামুল হক ও রূপণ ভূঁইয়া গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা- এ তথ্যের সত্যতা সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ।

গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত জাহান বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে এনামুল ও রূপণের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন তারা।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.