২১ আগস্টের হামলায় বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট: কাদের

0
নিজস্ব প্রতিবেদক

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার কারণে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক কর্ম সম্পর্ক চিরদিনের মত বিনষ্ট হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের।

গ্রেনেড হামলার ১৫ বছর পূর্তিতে সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের বেদীতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।

কাদের বলেন, ‘যারা বলেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কর্মসম্পর্কের যে অভাব রয়েছে, যে ঘাটতি রয়েছে, এটার জন্য দায়ী বিএনপি। তারা ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে দেয়াল তুলেছে, সে দেয়াল এভয়েট করা এড়িয়ে যাওয়া অথবা ভুলে যাওয়া আমাদের কোনোটাই সম্ভব নয়।’

‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কর্ম সম্পর্ক থাকা দরকার, সরকারি দল-বিরোধী দলের মধ্যে, সেই কর্মসম্পর্কের ভীত এই দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে চিরদিনের মত বিনষ্ট হয়ে গেছে।’

২০০৪ সালে বিএনপি শাসনামলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তারেক রহমানের নাম তখন থেকেই সামনে আনছে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। গত ১০ অক্টোবরের রায়ে আগে তারা বিএনপি নেতার ফাঁসির কামনা করেছিলেন। তবে খালেদা জিয়ার বড় ছেলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আর এতে স্পষ্টতই নাখোশ আওয়ামী লীগ।

রায়ে তারেক রহমানের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল বলেন মনে করেন ওবায়দুল কাদের। আর এ জন্য উচ্চ আদালতে যাবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

‘উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আমাদের আছে। এই হত্যাকাণ্ড যারা সংগঠিত করেছে, সেই হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের বক্তব্যে, জবানবন্দিতে আছে, তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনেই তারা সেদিন অপারেশন পরিচালনা করেছে। কাজেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হলে, এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডের বিচার হওয়া উচিত।’

১৫ আগস্টের মত ২১ অগাস্টের হত্যার বিচারও হবে বলে আশাবাদী কাদের। বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের বিচারিক আদালতে বিচার হয়েছে। পেপারবুক রেডি হচ্ছে, এর পর ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হবে।’

‘এখন প্রক্রিয়াগত ব্যাপার, যত দ্রুত সম্ভব ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক রক্তাক্ত ঘটনা, যেখানে ২৪টি তাজা প্রাণ হারিয়ে গেছে, নেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ। যেখানে প্রাইম টার্গেট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আল্লার অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে গেছেন। তিনি যখন বেঁচে আছেন, ১৫ আগস্টের যেমন বিচার হয়েছে তেমনি ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে।’

বিএনপি শাসনামলে প্রভাবশালী হয়ে উঠা বনানীর হাওয়া ভবনে এই হামলার পরিকল্পনা হয় বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে ফাঁসিতে ঝোলা জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তিনি জানান, এই হামলা পরিকল্পনা নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে তাদের।

‘মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদ সাহেব আমাদেরকে হাওয়া ভবনে নিয়ে গিয়ে তারেক জিয়া ও হারিছ চৌধুরী সাহেবদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আমরা আমাদের কাজ কর্মের জন্য তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চাইলে তারেক জিয়া আমাদের সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এরপর আমরা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরসহ আরো কয়েক জায়গায় গোপন মিটিং করি।’

‘আমরা ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে সিলেটে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভার সংবাদ জানতে পারি। সেখানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় তারেক জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত হয়। আমি, মাওলানা আবু তাহের, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাজউদ্দিন আল মারফাজুলের গাড়িতে করে মাওলানা রশিদসহ হাওয়া ভবনে যাই। সেখানে হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামের মুজাহিদ ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার, ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিমকেও উপস্থিত পাইছি, কিছুক্ষণ পর তারেক জিয়া আসেন। আমরা তাদের কাছে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর হামলা করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তাদের সহায়তা চাই। তখন তারা আমাদের সকল প্রকার প্রশাসনের সহায়তার আশ্বাস দেয়।’

‘তারেক সাহেব বলেন যে, আপনাদের এখানে আর আসার দরকার নাই, আপনারা বাবর সাহেব (সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) ও আবদুস সালাম পিন্টুর (সে সময়ের শিক্ষা উপমন্ত্রী) সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করবেন, তারা আপনাদের সকল প্রকার সহায়তা করবে।’

বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ‘নষ্টের’ জন্য ওবায়দুল কাদের ২০১৩ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথোপকথনের কথাও তুলে ধরেন। বলেন, ‘তারপরেও আমরা কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে যুগপদ আন্দোলন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের স্বার্থে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়াকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার সন্তানের মৃত্যুর পর পুত্রহারা মাকে সান্তনা দিতে বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন।’

‘সেদিন কি দূর্ব্যবহার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করা হয়েছে, এটা বাংলার মানুষ জানে। সেদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে সংলাপের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বিএনপি।’’

ওবায়দুল কাদের বলেন, তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হত্যাকে একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করেন।

‘১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা ও ২০০৪ সালে একুশে অগাস্ট তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা আমাদের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রাইম টার্গেট করে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশকে সেদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রসের মাধ্যমে  রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বিএনপি জামায়েত জোট সরকার।

‘ইতিহাসের এই দুটি ঘটনা একই সুত্রে গাথা একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। আমরা সেভাবেই বিষয়টিকে দেখি।’

এর আগে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে পর ১৪ দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম এবং অন্য শীর্ষ নেতারা।

এরপর একে একে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং ভাতৃপ্রতিম সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এই স্থানে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। মানববর্ম তৈরি করে নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করলেও প্রাণ হারায় ২৪ জন। আহত হয় শত শত নেতা-কর্মী।

এই হামলার পর সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ঘটনাটির তদন্ত ভিন্নখাতে নিতে চেয়েছিল বলে পরে প্রমাণ মেলে। হামলাকারীদের বাঁচিয়ে নিরীহ জজ মিয়াকে ফাঁসানোর চেষ্টা ফাঁস হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।

১৪ বছর পর গত ১০ অক্টোবরের রায়ে জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টুসহ ১৯ জনের ফাঁসি এবং তারেক রহমানসহ ১৮ জনের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়াও নানা মেয়াদে সাজা পেয়েছেন আরো ১১ জন। দণ্ডিতদের একটি বড় অংশ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত।

Leave A Reply